লিভার সিরোসিস লিভারের একটি রোগ। এটি লিভারের একটি অতি জটিল ও মারাত্মক রোগ । এতে লিভারের কোষকলা এমনভাবে ধ্বংস হয়ে যায় যে লিভার তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং লিভারে গুটি গুটি দেখা যায়।
এই রোগে লিভার তথা যকৃতের শেষ পর্যায়ের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের কারণে এর স্বাভাবিক কাঠামো স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয়। ফলে লিভারের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে লিভার দুর্বলতাজনিত জটিলতায় রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। লিভারের নিষ্ক্রিয়তা, লিভার ক্যান্সার ও লিভারজনিত মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো এই লিভার সিরোসিস।
সিরোসিস শব্দটি প্রথম বর্ণনা করেন বিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী ডা. রিনে লেনেক ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে। শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ কিরাস থেকে। যার শাব্দিক অর্থ তামাটে হলুদ অমসৃণ রং যা লিভারের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহে রোগীর শরীরে দেখা যায়।
আমরা জানি যকৃত বা লিভার হল মানুষের শরীরের একটি অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। পিত্ত নিঃসরণের মাধ্যমে খাবার হজম হতে শুরু করে শরীরের যাবতীয় বিপাকীয় কার্যাবলি এর দ্বারাই সম্পাদিত হয়। তাই লিভারের অসুস্থতার ফলাফল হয় ব্যাপক ও ভয়াবহ। অনেক রকম কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে। তবে কারণ যাই হোক কমপক্ষে ছয় মাসব্যাপী প্রদাহ না হলে লিভারের স্বাভাবিক কাঠামোর পরিবর্তন হয় না। লিভার সিরোরিস হতে সময় লাগে কমপক্ষে ৪-১০ বছর৷
লিভার সিরোসিসের কারণঃ
বাংলাদেশে সিরোসিসের প্রধান কারণ শরীরে হেপাটাইটিস 'বি' ভাইরাসের সংক্রমণ। এছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে ৷ যেমন -
ক) হেপাটাইটিস 'সি' ভাইরাস সংক্রমণ
খ) লিভারের অতিরিক্ত চর্বি
গ) অতিরিক্ত মদ্যপান
ঘ) ইমিউনোলজিক্যাল রোগ- অটোইমিউন লিভার ডিজিজ
ঙ) প্রাইমারি বিলিয়ারি সিরোসিস
চ) জেনেটিক/বংশানুক্রমিক রোগ, যেমন: হেমোক্রমাটোসিস, উইলসন্স ডিজিজ
ছ) অনেক সময় অন্য কোন রোগের ওষুধ সেবনের কারণে এটি হতে পারে
জ) কিছু অজ্ঞাত কারণ।
লক্ষণ / উপসর্গঃ
রোগীরা যদি ন্যুনতম ছয় মাস বা তার বেশিদিন উপরোক্ত কারণগুলোয় আক্রান্ত থাকে তাহলে লিভারে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ হয়ে সিরোসিসে রূপান্তরিত হয়। এ রোগের শুরুতে কোনো উপসর্গ থাকে না বললেই চলে। তবে আস্তে আস্তে রোগী শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুদামন্দা, পেট ফাঁপা, হজমে অনিয়ম এরূপ নানাবিধ সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো অসুখটি অনেকটা অগ্রসর না হওয়া পর্যন্ত আসক্ত রোগীর কোনো শারীরিক সমস্যা বা রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
প্রাথমিকভাবে এটির লক্ষণ খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না তবে এ রোগের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। যেমন-
* খাদ্যে অরুচি,
* ওজন হ্রাস,
* বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া,
* দুর্বলতা,
* জন্ডিস,
* পেটে পানি জমা
* পায়ে পানি জমা ৷
পরবর্তীতে লিভারের অকার্যকারিতার সঙ্গে কিডনির অকার্যকারিতা, রক্তবমি, পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া বা কাল পায়খানা করা, রক্তে আমিষ ও লবণের অসামঞ্জস্য ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয় ।
পরীক্ষাঃ
আপনার চিকিৎসক নিশ্চিত হবার জন্য আপনাকে মূলত কিছু পরীক্ষা করাবেন ।
১) লিভার বায়োপসি ( liver biopsy )– এটি এই রোগের জন্য প্রধান পরীক্ষা । তবে এটির প্রয়োজন নাও হতে পারে যদি অন্যান্য ল্যাব পরিক্ষায় চিকিৎসক নিশ্চিত হন। ল্যাব পরিক্ষায় আপনার চিকিৎসক Aminotransferases , Alkaline Phosphatase , Bilirubin ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হবেন ।
২) আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয় ৷ কিংবা এন্ডসকপি করা হতে পারে ৷
চিকিৎসা বা ম্যানেজমেন্টঃ
সিরোসিস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য কয়েকটি দিক লক্ষণীয় ৷ যেমন-
১. রোগ নির্ণয়
২. রোগের কারণ নির্ণয়
৩. রোগের জন্য সৃষ্ট জটিলতা নির্ণয়
৪. রোগীর বর্তমান অবস্থা ৷
এই চারটি বিষয় রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হয়। আর মূল চিকিৎসা এই দিকগুলো বিবেচনায় রেখে করতে হয় ৷
তবে লিভার সিরোসিস মূলত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনিরাময়যোগ্য । লিভার প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া যায় যা খুব ব্যয়বহুল । তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ আর সচেতনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ।
প্রতিরোধঃ
যেহেতু এটি মারাত্মক রোগ এবং এর চিকিৎসা অনিরাময়যোগ্য বা ব্যয়বহুল। তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ আর সচেতনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতাই পারে আমাদেরকে এরকম ভয়াবহ রোগ থেকে বাঁচাতে। যেমন-
* হেপাটাইটিস বি এর প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন নিতে হবে যা এখন খুবই সুলভ, এটি আপনাকে পূর্বেই নিতে হবে ।
* হেপাটাইটিস 'বি' ভাইরাসে আক্রান্ত মা গর্ভবতী হলে সন্তানের জন্মদানের সঙ্গে সঙ্গে দু'রকম টীকা দেয়া বাঞ্ছনীয় ৷
* লিভার সিরোসিসের যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
* মাদকদ্রব্য এড়িয়ে চলতে হবে ।
* প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ ও ফার্স্ট ফুডের কারনে অতিরিক্ত মেদ জমে। তাই এগুলো পরিহার করতে হবে ৷
* কোন রকম স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে ঝাড় ফুঁক, কবিরাজ, ওষুধ বিক্রেতার চিকিৎসা / মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের চিকিৎসা না নিয়ে একজন M.B.B.S ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে ৷
যাই হোক নিয়মিত জীবন ও খাদ্যাভ্যাস, নৈতিকতা বিরোধী কাজ পরিহার, পরিশ্রম ও ব্যায়াম এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। আর যারা এ রোগে আক্রান্ত তারা নিয়মিত লিভার ব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আজীবন চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এর জটিলতাগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন।